বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা কে, ইতিহাস এবং এর আয়তন কত এরকম বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আসে।
তাই আজকে আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য যারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা কে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তন কত বিঘা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট সম্পর্কে জানতে আগ্রহী।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা কে
১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল তৎকালীন প্রখ্যাত আইনজীবী এমএলএ মাদার বখশ এর। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের ফলে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান নামক একটি নতুন রাষ্ট্রের। ভাষা আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই ছাত্র জনতার মধ্যে উত্তরবঙ্গে অর্থাৎ রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একের পর এক আন্দোলনের সৃষ্টি হয়।
কেননা উত্তরবঙ্গের অঞ্চলগুলি তুলনামূলকভাবে শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল।তৎকালীন সময় উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের মধ্যে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাও ছিল রাজধানীতে। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অংশ খুব সহজলভ্য না থাকায় তারা উত্তরবঙ্গে অর্থাৎ রাজশাহীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য দাবি তোলে।
এ আন্দোলনের চাপে বাংলাদেশের অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে তৎকালীন সরকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।স্থানীয় আইন পরিষদের পূর্ববঙ্গীয় আইনসভার সদস্য প্রখ্যাত আইনজীবী এমএলএ মাদার বখশ এই আন্দোলনে একাত্ম হন।
এমএলএ মাদার বখশ ১৯৫৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি একটি জনসভায় সরকারকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য কঠিন হুঁশিয়ারি দেন। এরপরেই প্রাদেশিক আইনসভায় ১৯৫৩ সালের ৩১ শে মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইন পাশ হয়।
মাদার বখশ প্রফেসর ইতরাত হোসেন জুবেরী কে নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন।মাদার বখশ ও প্রফেসর ইতরাত হোসেন জুবেরী কে যুগ্ম সম্পাদক করে মোট ৬৪ সদস্য বিশিষ্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন একটি কমিটি গঠিত হয়।
১৯৫৩ সালের ৬ই জুলাই প্রফেসর ইতরাত হোসেন জুবেরী কে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক ভাবে যাত্রা শুরু হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালে সর্বমোট ১৬১ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রমের যাত্রা শুরু করেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস
১৮৭৩ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে অর্থাৎ রাজশাহীতে শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে রাজশাহী কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন রাজশাহী কলেজে আইন বিভাগসহ পোস্ট গ্রাজুয়েট শ্রেণি অর্থাৎ মাস্টার্স ডিগ্রী চালু করা হলেও কিছুদিন পরেই এ কলেজের সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে রাজশাহীতে উচ্চশিক্ষার জন্য একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অনুভূত হয়।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই পাকিস্তান সরকার দেশের কলেজ সমূহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করে। এ সময় রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী আন্দোলন শুরু হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের আগেই রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু হয়।
রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ১৯৫০ সালের ১৫ই নভেম্বর এ উপলক্ষে একটি কমিটি গঠন করা হয়। রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৫২ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি রাজশাহী শহরের ভুবনমোহন পার্কে সর্বপ্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
এর আগে ১৯৫২ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ পাস করার দাবিতে শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাজশাহী কলেজ প্রাঙ্গণে জমায়েত হয়। পরবর্তীতে এমএলএ আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ এর সভাপতিত্বে ১৯৫২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ভুবনমোহন পার্কেই আরো একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
এ জনসভায় মূল্যবান বক্তব্য রাখেন, এমএলএ ইদ্রিস আহমেদ, প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী, আনসার আলী, খোরশেদ আলম এবং আব্দুল জব্বার প্রমুখ। রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দাবি ক্রমেই তীব্র হয়। এ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে 15 জন ছাত্রনেতা কার্ড রধ্য হন। পরবর্তীতে ঢাকা একটি ডেলিগেশন পাঠানো হয় ছাত্র জনতার পক্ষ হতে।
এভাবে ক্রমাগত আন্দোলনের চাপে পড়ে রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় আইন পরিষদ গুরুত্ব দেয়। এই আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেন পূর্ববঙ্গীয় আইনসভার সদস্য এমএলএ প্রখ্যাত আইনজীবী মাদার বখশ।
মাদার বখশ ভুবন মোহন পার্কে ১৯৫৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আরও একটি জনসভায় বক্তব্য রাখেন। এ সভায় তিনি সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলেন, 'যদি রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না হয় তবে উত্তরবঙ্গকে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ দাবি করতে আমরা বাধ্য হবো। '
মাদার বখশ এর এই বক্তব্যে দেশের সুদী মহলে সারা পড়ে এবং সরকারও নড়েচড়ে বসে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য জনসাধারণের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার সম্ভাব্যতা একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদন অনুযায়ী রাজ সাহিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য উপযুক্ত বলে মনে হয়।
ফলে ১৯৫৩ সালের ৩১ শে মার্চ প্রাদেশিক আইন সভায় পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ কর্তৃক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইন পাস হয়। তৎকালীন গভর্নরের সম্মতিতে রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই সংবাদটি প্রথম ঢাকা গেজেটে প্রকাশিত হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন প্রফেসর ইতরাত হোসেন জুবেরীকে নিয়ে মাদারবখ্শ। তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার এমএ খুশী ছিলেন এর পৃষ্ঠপোষক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নে প্রফেসর ইতরাত হোসেন জুবেরী ও মাদারবখ্শ কে যুগ্ম সম্পাদক করে মোট ৬৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়।
১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রফেসর ইতরাত হোসেন জুবেরী কে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ করে যাত্রা শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয় টি ১৬১ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাস শুরু হয় রাজশাহী কলেজে।
পদ্মা নদীর তীরে বড় কুঠি নামে পরিচিত ঐতিহাসিক রেশম কুঠি বা নীল কুঠির উপর তলায় উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের দপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়। তৎকালীন ভোলানাথ বিশ্বেশ্বর হিন্দু একাডেমিতে বড় কুঠির কাছেই চিকিৎসা কেন্দ্র ও পাঠাগার তৈরি করা হয়। জমিদার কুঞ্জমোহন মৈত্রের বাড়িতে স্থাপন করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তর।
কলেজ পরিদর্শক দপ্তর স্থাপন করা হয় বড় কুঠিপাড়ার মাতৃধামে। ওসমান গনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রেজিস্টার হিসেবে নিযুক্ত হন এবং অধ্যাপক আব্দুল করিম প্রথম পরীক্ষার নিয়ন্ত্রক হিসেবে নিযুক্ত হন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রাবাস গড়ে ওঠে শহরের বিভিন্ন স্থানের ভাড়া করা বাড়িতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস হিসেবে রাজশাহী কলেজ সংলগ্ন ফুলার হোস্টেলকে রূপান্তরিত করা হয়। ছাত্রী নিবাস স্থাপন করা হয় বড়কুঠি এলাকার লালকুঠি ভবন এবং আরেকটি ভাড়া করা ভবনে।
বর্তমান ক্যাম্পাসের ভবন এবং রাস্তাঘাট নির্মাণ শুরু হয় ১৯৫৮ সালে এবং মতিহারের নিজস্ব ক্যাম্পাসের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম স্থানান্তর করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অফিস ও বিভাগ ১৯৬৪ সালের মধ্যে এখানেই স্থানান্তরিত করা হয়। অস্ট্রেলিয়ান স্থপতি ডক্টর সোয়ানি টমাসের স্থাপত্য পরিকল্পনায় এ ক্যাম্পাসটি গড়ে ওঠে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তন কত বিঘা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ক্যাম্পাস মতিহার সবুজ চত্বর নামে পরিচিত।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের লক্ষ্যে ২৯৮.২০ জমি অধিগ্রহণ করা হয়। বিদেশি আর্কিটেক্ট জন এ জোমানেক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করেন।
১৯৫৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের রাস্তাঘাট ও ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৬৪ সালের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অফিস হস্তান্তর করা হয় যা বর্তমান ক্যাম্পাস মতিহার সবুজ চত্বর নামে পরিচিত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ক্যাম্পাসের আয়তন প্রায় ৭৫৩ একর বা ৩০৪ হেক্টর (জমি)। বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পাঁচটি উচ্চতর গবেষণা ইনস্টিটিউট, নয়টি অনুসদের অধীনে ৫৯ টি বিভাগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ক্যাম্পাসের উত্তর-পূর্ব দিকে ছাত্রদের জন্য ১১ টি আবাসিক হল রয়েছে এবং পশ্চিম দিকে ছাত্রীদের জন্য ছয়টি আবাসিক হল রয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব দিকে রয়েছে গবেষকদের জন্য একটি ডার্মিটরি। পূর্ব-পশ্চিম দিকে শিক্ষক ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য রয়েছে একটি আবাসিক এলাকা। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে দেশের সর্বপ্রথম শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ভাস্কর্য সাবাস বাংলাদেশ এবং গোল্ডেন জুবিলী টাওয়ার।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট
এই ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে যেকোনো তথ্য জানতে পারবেন। বর্তমান অনলাইনের যুগে আশা করি এই ওয়েবসাইট থেকে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবেন।
0 Comments