প্রায় দেড় যুগ পরে শিক্ষা ক্যাডারে বিশেষ বিসিএস শুরু হতে যাচ্ছে-সরকারি কলেজগুলোতে গড়ে ২৫ শতাংশ শিক্ষক সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগ গুলোতে শিক্ষক সংকট রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকায় ক্লাসগুলো ঠিকঠাক হচ্ছে না ফলে ক্লাসের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে।
তাই শিক্ষা ক্যাডারে বিশেষ বিসিএস এ কতজন শিক্ষক নিয়োগ হবে বলে সরকার ঘোষণা দিয়েছেন সে বিষয়ে আজকে আর্টিকেলের তুলে ধরা হয়েছে।
প্রায় দেড় যুগ পরে শিক্ষা ক্যাডারে বিশেষ বিসিএস শুরু হতে যাচ্ছে
প্রায় দেড় যুগ পরে শিক্ষা ক্যাডারে বিশেষ বিসিএস শুরু হতে যাচ্ছে এমনটাই ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকার। তবে এবারের বিশেষ বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডার ও স্বাস্থ্য ক্যাডার একত্রে নিয়োগ দেওয়া হবে।
শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাষক পদে ৬৮৩ জন নিয়োগ দেয়া হবে এবং স্বাস্থ্য ক্যাডারে তিন হাজার ৩০ জনকে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সরকার।
শিক্ষা ক্যাডারে ২৬তম বিশেষ বিসিএস এর মাধ্যমে ২০০৬ সালে সর্বশেষ প্রভাষক নিয়োগ করা হয়। ওই সময় বিশেষ বিসিএসের প্রভাষক পদে ১ হাজার ৪৭ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়।
এরপরে শিক্ষা ক্যাডার সাধারণ বিসিএস ক্যাডারের সঙ্গে নিয়োগ দেওয়ায় পরবর্তীতে আর কোন বিশেষ বিসিএস এর মাধ্যমে শিক্ষা ক্যাডার এর প্রভাষক পদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
কিন্তু সরকারি কলেজগুলোতে হাজার হাজার শূন্য পদে শিক্ষা ক্যাডারের নিয়োগের জন্য সংশ্লিষ্টরা বিশেষ বিসিএস আয়োজনের জন্য দফায় দফায় সুপারিশ করে আসছে। যদিও গত ১০ বছরে শিক্ষা ক্যাডার বিশেষ বিসিএস নেওয়ার উদ্যোগ দুইবার হলেও পরবর্তীতে তা কোন এক অজানা কারণে আটকে যায়।
বর্তমানে সরকারি কলেজগুলোতে গড়ে ২৫ শতাংশ শিক্ষক পদ শূন্য জানিয়েছেন মাউশি (মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর)। বিশেষ করে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষক সংকট এতটাই বেশি যে এই বিভাগগুলোর ক্লাস নেওয়াটাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
ক্লাসে শিক্ষার্থী না থাকলেও পরীক্ষার সময় পরীক্ষার্থীদের দেখা যায়। কেননা শিক্ষক সংকটে নিয়মিত ক্লাস না হওয়ায় ক্লাসে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে তারা ক্লাস না করে শুধু পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিতে আসে।
এমতাবস্থায়, সরকারি কলেজের শিক্ষক সংকট নিরসনে পাবলিক সার্ভিস কমিশন শিক্ষা ক্যাডারে বিশেষ বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করেছে।
৫ ই আগস্ট ২০২৪ দেশের পদ পরিবর্তনের পর সরকার ছয় সদস্য বিশিষ্ট 'জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটি' গঠন করেন। এ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব রয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ।
এ কমিটিতে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফওজুল কবির খান সদস্য হিসেবে রয়েছেন। এই কমিটি দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে এপ্রিল মাসে দফায় দফায় বৈঠক শেষে শিক্ষা ক্যাডার বিশেষ বিসিএস এর সুপারিশ করে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এই দুই ক্যাডারে হঠাৎ করে বিশেষ বিসিএস এর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফওজুল কবির খান সাংবাদিকদের জানান, শিক্ষা বিভাগের জরুরি চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে (শিক্ষক সংকট নিরসনে) দ্রুততম সময়ের মধ্যে ৬৮৩ জন প্রভাষক নিয়োগ দিতে পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে (পিএসসি) বিশেষ বিসিএস এর আয়োজন করতে বলা হয়েছে।একই সাথে স্বাস্থ্য ক্যাডারের জন্যও ৩ হাজার ৩০ জন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হবে।
সরকারি কলেজগুলোতে প্রভাষক পদে হাজার হাজার শূন্য পদ থাকা সত্ত্বেও কেন মাত্র ৬৮৩ জনের জন্য বিশেষ বিসিএস ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফওজুল কবির খান সাংবাদিকদের জানান, ক্যাডার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পাঠানো জরুরি ও প্রয়োজনীয় সংখ্যাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে এখানে।
ইতিমধ্যে শিক্ষা ক্যাডারের বিশেষ বিসিএস এর কাজ শুরু করে দিয়েছে পিএসসি। সর্বশেষ কয়েকটি বিসিএস নিয়ে কিছু জটিলতা থাকলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা ক্যাডারের বিশেষ বিসিএস চাহিদা পাওয়ার পর থেকেই তারা এটা নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে।
মাউশির (মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা মাধ্যমিক অধিদপ্তর) কর্মকর্তার তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে কলেজ রয়েছে ৬৬৩ টি। এর মধ্যে গত ১০ বছরে প্রায় অর্ধেক কলেজ সরকারিকরণ করা হয়েছে। সে সকল কলেজের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা এখন পর্যন্ত সরকারি কলেজের সুযোগ সুবিধা গুলো পুরোপুরিভাবে ভোগ করতে পারছেন না।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যা ব্যুরো ব্যানবেইসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি কলেজ গুলোর প্রতি ৯৭ জন শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র একজন। সমীক্ষা অনুযায়ী যা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। দেশের সরকারি কলেজগুলোতে ২০১৮ সালে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৭৯ ছিল।
এ বিষয়ে পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান জানান, গত ১০ বছরে শিক্ষার জন্য বিশেষ বিসিএস এর আয়োজন কয়েকবার চেষ্টা করা হলেও তা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। তিনি এখানে কারণ হিসেবে আন্তঃ ক্যাডার দ্বন্দ্বকে উপস্থাপন করেছেন।
বিশেষ বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে কতজন নিয়োগ দেওয়া হবে
বিশেষ বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে ৩ হাজার ৩০ জন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হবে। বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় ৩ হাজার ৩০ টি সুপারনিউমারারি পদ অস্থায়ীভাবে রাজস্ব খাতে তৈরীর প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে।
প্রথম পর্যায়ে ১৫০ টি অধ্যাপক, ৮৫০ টি সহযোগী অধ্যাপক এবং সহকারি অধ্যাপকের ২হাজার ৩০টি পদ তৈরীর প্রস্তাব করা হলে এ প্রস্তাবের অনুমোদন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য সেবায়ও চিকিৎসক সংকট রয়েছে শিক্ষার মতই। বর্তমানে দেশের সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে, চিকিৎসক, প্যারামেডিক চিকিৎসক ও নার্সের গড়ের ২৭ শতাংশ পদ শূন্য রয়েছে।
প্রথম গ্রেড হতে ২০ তম গ্রেড পর্যন্ত ২ লাখ ৩৬ হাজার ৮২৮ টি পদ অনুমোদিত থাকলেও বর্তমানে ১ লাখ ৭৩ হাজার ২৬১ টি পদে চিকিৎসক কর্মরত আছেন। বর্তমানে ৬৩ হাজার ৫৭১ টি শূন্য পদ রয়েছে।
চিকিৎসক সংকটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে গ্রাম অঞ্চলের স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলো। গ্রাম অঞ্চলের স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র গুলোতে ৪০ শতাংশ শূন্য পদ রয়েছে। অনুমোদিত পদের বিপরীতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ৫৮ শতাংশ সংকট এবং সাধারণ চিকিৎসকের ২৫ শতাংশ সংকট রয়েছে।
৪৩তম বিসিএস হতে ৪৭ তম বিসিএস এর বর্তমান পরিস্থিতি
পিএসসির বিগত কয়েকটি বিসিএস এ বেশ কিছু জটিলতা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের বিশেষ বিসিএস এর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ৪৩ তম বিসিএস হতে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত ৪৭ তম বিসিএস পর্যন্ত জটিলতা গুলো তুলে ধরা হলো-
৪৩তম বিসিএস : ৪৩তম বিসিএস পরীক্ষার ফলাফল চূড়ান্ত হওয়ার পরেও ২৬৭ জন সদ্য বিসিএস ক্যাডার বাদ পড়েছেন। তাই তাদের কোন নিয়োগের জন্য আন্দোলন চলছে।
৪৪তম বিসিএস : ৪৪তম বিসিএস মৌখিক পরীক্ষা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। দ্বিতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু হবে ২০শে মে এবং ২৪শে জুন শেষ হবে। এর আগে প্রথম ধাপের মৌখিক পরীক্ষা সমাপ্ত হয়েছে।
৪৫তম বিসিএস : ৪৫তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার ফলাফল আগামী জুন মাসে প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন পিএসসি।
৪৬তম বিসিএস : ৪৬ তম বিসিএস এর লিখিত পরীক্ষা ৮ ই মে শুরু হয়েছে এবং শেষ হবে ১৯শে মে।
৪৭তম বিসিএস : ৪৭তম বিসিএস এর প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শুরু হবে আট ই আগস্ট ২০২৫ সাল।
সর্বশেষ, বর্তমানে সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের শিক্ষক এবং চিকিৎসক সংকট নিরসনের লক্ষ্যে জরুরী ব্যবস্থায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার বিশেষ বিসিএস নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা মনে করেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য আলাদা পিএসসি নিয়োগ ব্যবস্থা চালু হলে এ সংকট থাকবে না। কিন্তু যতদিন এই ব্যবস্থা চালু না হচ্ছে, ততদিন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কেন নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভূমিকা পালন করতে হবে।
0 Comments