শেখ হাসিনা কবে ক্ষমতায় আসেন এবং কিভাবে দেশ ত্যাগ করেন

শেখ হাসিনা কবে ক্ষমতায় আসেন এবং কিভাবে দেশ ত্যাগ করেন -আওয়ামী লীগের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিভাবে দেশ ত্যাগ করেন তা আমাদের কারোরই অজানা নয়। কিন্তু শেখ হাসিনা কিভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসেন সেটা সিনিয়র ব্যক্তিবর্গ ব্যতীত বর্তমান জেনারেশনের অধিকাংশই জানিনা। 


তাই আজকের আর্টিকেলে শেখ হাসিনা কবে ক্ষমতায় আসেন এবং শেখ হাসিনার দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি পুনরায় তুলে ধরেছি। এর পাশাপাশি শেখ হাসিনা কতবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন, শেখ হাসিনার শাসনকাল কত বছর এবং শেখ হাসিনা কবে পদত্যাগ করেছিলেন সে সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। 



শেখ হাসিনা কবে ক্ষমতায় আসেন এবং কিভাবে দেশ ত্যাগ করেন



শেখ হাসিনা কবে ক্ষমতায় আসেন এবং কিভাবে দেশ ত্যাগ করেন 

শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিনিধি হয়ে ক্ষমতায় আসার পথ কখনোই সহজ ছিল না। আওয়ামীলীগ সরকারের পরাজয়ের দীর্ঘ ২১ বছর পরে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পূর্বে যে পথ তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে তা পর্যায়ক্রমে নিচে তুলে ধরেছি। 


আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমে ক্ষমতায় আসেন বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে। ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারকে একদল সামরিক বাহিনী হত্যা করে। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ইতি ঘটে। 


শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর ১৯৭৫ সালে ক্ষমতায় আসেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জিয়াউর রহমান। ক্ষমতায় আসার পর তিনি ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সংক্ষেপে বিএনপি নামক একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে। ৩০শে মে ১৯৮১ মেজর জিয়াউর রহমান নিহত হন সামরিক বাহিনীর সদস্যদের হাতে।


মেজর জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশ সরকারের ক্ষমতায় আসেন তৎকালীন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল সংক্ষেপে জাগদল এর সমন্বয়ক আব্দুস সাত্তার। 


কিন্তু তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসাইন মুহম্মদ এরশাদের রাজনৈতিক বাসনা প্রকাশ হয়ে পড়ে। তিনি নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার কে সরিয়ে দিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এবং ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন শুরু করেন।তিনি পরবর্তীতে স্বৈরশাসক নামে অভিহিত হন। 


অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়াউর রহমান নিহতের মাত্র ১২ দিন পূর্বে ১৯৮১ সালের ১৭ই মে আওয়ামী লীগ সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জৈষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাকে তাদের সভাপতি হিসেবে গ্রহণ করেন।


আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মিলে গণতন্ত্রের দাবিতে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর হুসাইন মুহম্মদ এরশাদের পতন হয়। এর মধ্য দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা চালু হয়। 


১৯৯০ সালের পঞ্চম জাতীয় নির্বাচনে জনগণের ভোটে বিজয়ী হয়ে বিএনপি ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করেন। ১৯৯৪ সালের দুটি উপনির্বাচনে সরকার হস্তক্ষেপ করেছে বলে আওয়ামী লীগ সরকার অভিযোগ করে। 


 ১৯৯৪ সালে সরকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগের আশঙ্কা হয় জাতীয় নির্বাচনে নিরপেক্ষতা নিয়ে। তাই নির্বাচন চলাকালীন সময়ে কেয়ারটেকার অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে।


১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ পুনরায় বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসে। কিন্তু আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে যে, বিএনপি একতরফা নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতায় আসে। আওয়ামী লীগের আন্দোলনের চাপে পড়ে বিএনপি সরকার প্রধান বেগম খালেদা জিয়া মাত্র দেড় মাসের মাথায় কত ত্যাগ করেন। 



শেখ হাসিনা কবে ক্ষমতায় আসেন এবং কিভাবে দেশ ত্যাগ করেন



১২ জুন ১৯৯৬ সপ্তম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসেন।আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৯৬ সালের ২৩ শে জুন তার কার্যকাল শুরু করেন। তার এই সরকারের মেয়াদ ছিল ২০০১ সালের ১৫ জুলাই পর্যন্ত।


এরপর বিএনপি সরকার মাত্র একবার ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পুনরায় ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসেন। 



শেখ হাসিনা দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসেন ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ৬ জানুয়ারি ২০০৯ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। 



আওয়ামী লীগ সরকারের শেখ হাসিনা ২০০৯-২০২৪ সাল পর্যন্ত একটানা ১৫ বছর প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় ছিলেন। ২০০৯ সালের পর ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হন।  ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০১৯ সালে ক্ষমতায় বসেন। সর্বশেষ ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পুনরায় বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন। 



২০১৪ থেকে ২০২৪ এর নির্বাচনগুলোর স্বচ্ছতার অভাবের জন্য ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ এর নির্বাচন ব্যাপকভাবে সমালোচিত  হয়েছে এবং সরকার বিরোধী দল গুলো এ নির্বাচনকে বয়কট করে। শুধু তাই নয় আন্তর্জাতিক মহলের পর্যবেক্ষকরা ও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে এ সকল নির্বাচনকে ভোট জালিয়াতি ও দমন পীড়নের অভিযোগ তোলে। 



শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের জুলাই মাসে চীনের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে চীন সফর শেষে দেশে ফিরেন। এই সময় দেশে কোটা সংস্কারের সমর্থনে ছাত্ররা কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেন। 


এর পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা একটি প্রেস কনফারেন্স করেন এবং এ প্রেস ব্রিফিং এ বলেন, 'যদি মুক্তিযুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিরা কোটা সুবিধা না পান, তবে তা কি রাজাকারদের নাতিদের কাছে যাবে? এটা আমার প্রশ্ন দেশের মানুষদের কাছে।'




শেখ হাসিনা কবে ক্ষমতায় আসেন এবং কিভাবে দেশ ত্যাগ করেন




সরকারের এমন অভিব্যক্তিতে ছাত্ররা আরো ক্ষেপে উঠেন এবং রাজাকার রাজাকার শিরোনামে স্লোগান দেন। পরবর্তীতে এ বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নেয়। প্রশাসনের পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী এবং আওয়ামীলীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সদস্যরা জড়িত হয়ে ছাত্রদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং তাদের উপর লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ এবং পরবর্তীতে গুলি বর্ষণ করেন নিরীহ ও নিরস্ত্র ছাত্র জনতার উপর। এর ফলে অসংখ্য ছাত্র জনতা নিহত ও আহত হয়। 



এরপর সরকার হঠাৎ করেই আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করতে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেন এবং সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগিতায় আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার উপর গুলি বর্ষণ, গরম পানি নিক্ষেপ সহ ব্যাপক দমন পীড়ন চালায় এবং দেশে কারফিউ জারি করে।



বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারীরা প্রথমে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া এবং কিছু মন্ত্রীর পদত্যাগ চাওয়া সহ কয়েক দফা জারি করলেও পরবর্তীতে তা এক দফা আন্দোলনের রূপ নেয়। 


৩ আগস্ট ২০২৪ বৈষম্য বিরোধী ছাত্ররা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ চেয়ে এক দফা দাবি উপস্থাপন করেন এবং অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেয়।


ছাত্র জনতার চাপের মুখে পড়ে ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং বিকেল তিনটার দিকে বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে আকাশ পথে ভারতে পালিয়ে যান (কথিত, সামরিক বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার যোগে  আগরতলা হয়ে দিল্লিতে পৌঁছান)। 



সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগের পূর্বে একটি বক্তৃতা রেকর্ড করার ইচ্ছা পোষণ করলেও সময়ের অভাবে তিনি তা করার সুযোগ পাননি। কারণ যেভাবে ছাত্র-জনতা তার প্রধান কার্যালয়ের দিকে ধাবিত হয়ে আসছিল তাতে আর কিছুক্ষন দেরি করলে হয়তো বা তার প্রাণ নাশের ভয় ছিল। 



এভাবেই আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরের স্বৈরাশাসনের অবসান হয় এবং বাংলার সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে এলিট শ্রেণী পর্যন্ত স্বৈরশাসকের হাত থেকে মুক্ত হন। সাধারণ ছাত্র জনতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশত্যাগের ফলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আনন্দ উল্লাস করে। 


শেখ হাসিনা কতবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন

১৯৯৬ সাল হতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা পাঁচ বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। 



শেখ হাসিনা সংসদ সদস্য কতবার হয়েছে

শেখ হাসিনা মোট ৭ বার সংসদ সদস্য হয়েছেন। তিনি ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৯ এবং ২০২৪ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। 



শেখ হাসিনার শাসনকাল কত বছর

শেখ হাসিনার শাসনকাল ১৯৯৬ সাল হতে ২০০১ সাল পর্যন্ত ৫ বছর এবং ২০০৯ সাল হতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত একটানা 15 বছর। শেখ হাসিনার শাসনকাল ছিল সর্বমোট ২০ বছর। 


শেখ হাসিনা কবে পদত্যাগ করেছিলেন

২০২৪ সালের ৫ ই আগস্ট ছাত্র জনতার চাপের মুখে পড়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ হতে সেনা প্রধান কাছে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ শেষে সেনাপ্রধানের সহায়তায় ছোট বোন শেখ রেহানাকে সাথে নিয়ে বিকেল তিনটার দিকে দেশ ছেড়ে হেলিকপ্টার যোগে ভারতে পালিয়ে যান। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগ শেষে গণভবনে জনতা আনন্দে উল্লাসে মেতে ওঠে। 




শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগ শেষে গণভবনে জনতার আনন্দ উল্লাস




শেখ হাসিনার ক্ষমতার সময়কাল কত

শেখ হাসিনা মোট ৫ বার সরকার ক্ষমতায় আসে। শেখ হাসিনার ক্ষমতার সময় কাল —

প্রথমবার — ১৯৯৬ সাল হতে ২০০১ সাল পর্যন্ত। 
দ্বিতীয়বার — ২০০৯ সাল (নির্বাচন ২০০৮) হতে ২০১৪ সাল পর্যন্ত। 
তৃতীয়বার — ২০১৪ সাল হতে ২০১৮ সাল পর্যন্ত।
চতুর্থবার — ২০১৯ সাল (নির্বাচন ২০১৮) হতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত।
পঞ্চম বার — ২০২৪ সাল (নির্বাচন ৭ই জানুয়ারি) হতে ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট পর্যন্ত।

২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার অবসান হয়। 




সর্বশেষ, বাংলাদেশের সন্ত্রাস বিরোধী আইনের অধীনে ১০শে মে ২০২৫ আওয়ামী লীগ এর যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ তার দলের নেতা কর্মীদের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা জারি থাকবে। 

Post a Comment

0 Comments